মহালয়া
মহালয়ার তাৎপর্য: পূর্বপুরুষের স্মৃতির সাথে দেবীর আগমনী সুর
মহালয়া থেকেই শুরু হয় দেবীপক্ষ
সৌরভ চক্রবর্ত্তী : শরৎ আসতেই বাঙালির মন কাঁপতে শুরু করে। আকাশে সাদা তুলোর মেঘ, বাতাসে শিউলির গন্ধ আর কানে বাজতে থাকে ঢাকের তাল। কিন্তু শারদোৎসবের সূচনার আগে বাঙালির আবেগকে নাড়া দেয় এক বিশেষ দিন—মহালয়া। পিতৃপক্ষের অবসান আর দেবীপক্ষের সূচনা—দুইয়ের সংযোগসূত্র এই মহালয়া।
পিতৃপক্ষের অবসান ও দেবীপক্ষের সূচনা:
শাস্ত্র অনুযায়ী, মহালয়া হল ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষ অমাবস্যা তিথি। এই দিন হিন্দু সমাজে পালিত হয় তর্পণ ও শ্রাদ্ধের আচার। বিশ্বাস করা হয়, পূর্বপুরুষরা এই সময় ধরাধামে আগমন করেন এবং তাঁদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত অর্ঘ্য সরাসরি তাঁদের কাছে পৌঁছে যায়। পরিবার-পরিজনের আত্মার শান্তি ও মুক্তির প্রার্থনা করা হয় এই দিনে।
অন্যদিকে, মহালয়া থেকেই শুরু হয় দেবীপক্ষ। দেবী দুর্গার আবাহনের সুর ধ্বনিত হতে থাকে। ভোরের আকাশে রেডিওতে ভেসে ওঠা “মহিষাসুরমর্দিনী”র চণ্ডীপাঠ যেন বাঙালির ভোরকে অন্য মাত্রা দেয়। একদিকে পূর্বপুরুষ স্মরণ, অন্যদিকে দেবীর আগমনী বার্তা—এই দ্বৈত তাৎপর্যই মহালয়াকে করেছে অনন্য।
শব্দার্থ ও আধ্যাত্মিক অর্থ:
‘মহালয়া’ শব্দের অর্থ ‘মহান আশ্রয়’। একে কেউ বলেন পিতৃপুরুষের আশ্রয় দিবস, আবার কারও কাছে এটি দেবীর আবাহনের সূচনা। ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষ প্রতিপদ থেকে অমাবস্যা পর্যন্ত সময়কে ধরা হয় পিতৃপক্ষ, আর তারই সমাপ্তি হলো মহালয়া।
মহাভারতের কর্ণকাহিনি:
মহালয়ার সঙ্গে জড়িয়ে আছে মহাভারতের কর্ণের গল্প। জীবদ্দশায় কর্ণ অসীম দানশীল হলেও কখনও অন্ন দান করেননি। মৃত্যুর পর স্বর্গে তিনি পেলেন সোনা ও রত্ন, কিন্তু খাদ্য পেলেন না। তখন কর্ণের অনুরোধে দেবতারা তাঁকে এক পাক্ষিক সময়ের জন্য পৃথিবীতে ফিরে আসার সুযোগ দেন, যাতে তিনি অন্ন-জল দান করতে পারেন। সেই থেকেই পিতৃপক্ষ পালনের প্রথা গড়ে ওঠে, আর তার সমাপ্তি ঘটে মহালয়ার দিন।
পৌরাণিক কিংবদন্তি:
অন্য একটি কাহিনি বলে, প্রলয়ের সময় ভগবান বিষ্ণুর কর্ণমূল থেকে জন্ম নেয় মধু ও কৈটভ নামক দুই অসুর। তারা ব্রহ্মাকে বন্দি করে রাখে। তখন দেবী যোগনিদ্রার প্রভাবে ঘুমন্ত বিষ্ণুকে জাগানো হয়। দীর্ঘ হাজার বছরের যুদ্ধ শেষে বিষ্ণু তাঁদের বধ করেন। সেই সময় থেকেই দেবীপক্ষের সূচনা ধরা হয়, আর মহালয়া সেই সূচনার বার্তাবাহক।
বাঙালির আবেগে মহালয়া:
মহালয়া মানেই চণ্ডীপাঠ, শিউলির গন্ধ, ঢাকের শব্দ আর মনের ভেতরে উৎসবের আগমনী বার্তা। ভোরবেলায় বেতারে ভেসে আসা “যা দেবী সর্বভূতেষু…” স্তোত্রপাঠ যেন বাঙালির অন্তর জুড়ে শিহরণ তোলে। দেবীপক্ষের আবাহনের সঙ্গে পূর্বপুরুষ স্মরণের মিলনে এই দিনটি বাঙালির কাছে এক অনন্য আবেগের প্রতীক।
মহালয়া কেবল একটি তিথি নয়। এটি বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা, আধ্যাত্মিক বিশ্বাস ও উৎসবের আগমনী সুর—সব মিলিয়ে মহালয়া বাঙালির কাছে চিরন্তন আবেগের নাম। প্রতি বছর মহালয়ার ভোরে শিউলির সুবাস মেখে নতুন করে শুরু হয় বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব—শারদোৎসব।

Comments