মিজোরাম
ভারতের স্বাধীনতার ৭৮ বছর পর মিজোরামে রেল যোগাযোগের সূচনা – এ এক নতুন ইতিহাস!
প্রতীক্ষার অবসান ঘটল সাইরাং রেলস্টেশনের উদ্বোধনের মাধ্যমে ভারতের অখণ্ডতার বাস্তব রূপায়ণ মিজোরামে রেল যোগাযোগ সূচনা
সৌভিক দাস, ১৩ ই সেপ্টেম্বর : ভারতের স্বাধীনতার দীর্ঘ ৭৮ বছর পর অবশেষে দেশের অন্যতম দুর্গম ও ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন রাজ্য মিজোরাম যুক্ত হলো ভারতীয় রেল নেটওয়ার্কের সঙ্গে। ২০২৫ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করলেন মিজোরামের প্রথম রেলস্টেশন সাইরাং-এ। এই উদ্বোধন নিছক একটি অবকাঠামোগত সাফল্য নয়, এটি উত্তর-পূর্ব ভারতের উন্নয়ন, ঐক্য এবং অগ্রযাত্রার প্রতীক হয়ে রইল।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল বহুদিন ধরেই দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ছিল। পাহাড়ি অঞ্চল, ঘন বনভূমি, দুর্গম আবহাওয়া এবং সীমান্তবর্তী অবস্থানের কারণে এখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করা সবসময়ই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। স্বাধীনতার এত বছর পরও মিজোরাম ছিল ভারতের কয়েকটি রাজ্যের মধ্যে একমাত্র, যেখানে রেলপথ পৌঁছায়নি। আজ সেই দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটল। সাইরাং রেলস্টেশনের উদ্বোধনের মাধ্যমে ভারতের অখণ্ডতার বাস্তব রূপায়ণ ঘটল।
সাইরাং রেলস্টেশনের অবস্থান মিজোরামের রাজধানী আইজল থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে। এই প্রকল্পের কাজ বহু বছর ধরে চলছিল। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা থেকে মিজোরামের পাহাড়ি এলাকায় রেললাইন নির্মাণ করা প্রকৃতপক্ষে ছিল এক বড় প্রকৌশলগত চ্যালেঞ্জ। অসংখ্য টানেল, দুর্গম পাহাড়ি পথ এবং ভারতের সবচেয়ে উঁচু রেল সেতুগুলির একটি নির্মাণ করতে হয়েছে এই লাইনে। এটি শুধু রেল যোগাযোগ নয়, বরং দেশের প্রকৌশল দক্ষতার এক অনন্য নিদর্শন হয়ে দাঁড়াল।
রেল যোগাযোগ চালু হওয়ায় মিজোরামের মানুষ নতুন সম্ভাবনার দরজা খুঁজে পেলেন। এতদিন পণ্য পরিবহন বা ব্যবসার জন্য মূলত সড়ক ও বিমানপথের ওপর নির্ভর করতে হতো। এর ফলে ব্যয় অনেক বেড়ে যেত এবং বাণিজ্যের গতি সীমিত থাকত। এখন রেলপথ চালু হলে কৃষিপণ্য, বনজ সম্পদ কিংবা স্থানীয় উৎপাদিত দ্রব্য দেশের অন্যান্য প্রান্তে সহজে পৌঁছানো সম্ভব হবে। একইসঙ্গে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকেও সস্তায় দ্রব্য মিজোরামে আসবে। এতে স্থানীয় বাজার প্রাণবন্ত হবে, বাণিজ্যের পরিধি বাড়বে এবং কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে।
শুধু অর্থনীতি নয়, পর্যটনের ক্ষেত্রেও এই রেলপথ বিশাল পরিবর্তন আনবে। মিজোরাম পাহাড়ি সৌন্দর্য, প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ হলেও এতদিন যোগাযোগ সমস্যার কারণে পর্যটকরা কম আসতেন। এখন রেল চালু হলে উত্তর-পূর্ব ভারতের পর্যটন মানচিত্রে মিজোরামের অবস্থান আরও শক্তিশালী হবে।
এই রেল সংযোগ ভারতের ঐক্যের প্রতীকও বটে। বহুদিন ধরে উত্তর-পূর্ব ভারতের মানুষ অভিযোগ করছিলেন যে তারা উন্নয়নের মূলস্রোত থেকে পিছিয়ে পড়েছেন। রেল সংযোগ সেই বঞ্চনার অবসান ঘটাল। দেশের প্রতিটি প্রান্তকে এক সূত্রে বাঁধার যে প্রয়াস, তার বাস্তব প্রমাণ হয়ে উঠল সাইরাং রেলস্টেশন। এটি “এক ভারত, শ্রেষ্ঠ ভারত”-এর ভাবনাকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করল।
কৌশলগত দিক থেকেও এই রেলপথ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মিজোরাম বাংলাদেশের সঙ্গে প্রায় ৩১৮ কিলোমিটার এবং মায়ানমারের সঙ্গে প্রায় ৪০৪ কিলোমিটার সীমান্ত ভাগ করে নিয়েছে। সীমান্তবর্তী রাজ্যে রেল যোগাযোগ নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার জন্য বড় ভূমিকা রাখবে। সেনা ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দ্রুত সরবরাহ করা যাবে এবং জরুরি অবস্থায় সহায়তাও সহজ হবে। ফলে সীমান্ত রক্ষার ক্ষেত্রেও এই রেল সংযোগ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠবে।
মিজোরামের সাধারণ মানুষের কাছে এই রেল সংযোগ নতুন জীবনের প্রতীক। বহুদিন ধরে তারা এর জন্য অপেক্ষা করেছেন। রেল চালু হওয়ায় তারা শুধু দেশের সঙ্গে সহজে যুক্ত হবেন না, বরং নিজেদের সংস্কৃতি, শিল্প এবং জীবনধারাকে ভারতের অন্যান্য প্রান্তে পৌঁছে দেওয়ার সুযোগও পাবেন।
ভবিষ্যতের দিক থেকেও এই রেললাইন অনেক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে। সাইরাং হয়ে মায়ানমারের সঙ্গে রেল যোগাযোগ গড়ে উঠতে পারে, যা ভারতের “অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি”-র অংশ হিসেবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাজারে প্রবেশের পথ খুলে দেবে। বাণিজ্য, অর্থনীতি এবং আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রেও এটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
সাইরাং রেলস্টেশনের উদ্বোধন নিছক একটি পরিবহন প্রকল্প নয়, এটি ভারতের উন্নয়ন, ঐক্য এবং আন্তর্জাতিক কৌশলগত ভাবনার এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। স্বাধীনতার ৭৮ বছর পর মিজোরামে রেল পৌঁছানো মানে শুধু ভৌগোলিক সংযোগ নয়, এটি মানুষের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত স্বপ্নের বাস্তবায়ন। উত্তর-পূর্ব ভারতের অগ্রযাত্রার নতুন দিগন্ত হিসেবে আজকের দিনটি ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

Comments